নারীর অবস্থান জানান দিল ‘হিম্মতি মাঈ

 শনিবার বিকেল। রাজধানীর জাতীয় শিল্পকলা একাডেমির সামনের সড়কে জড়ো হয়েছেন শতাধিক নারী। সবার হাতে বাঁশের লাঠি। সড়কে সেই লাঠি ঠুকছেন তাঁরা, তালে তালে। তাঁদের পেছনে বসে ক্রমাগত ড্রাম বাজাচ্ছেন চেতনা রহমান নামের এক তরুণী। এক ঘণ্টায় একটিবারের জন্যও তাঁর এই ড্রামবাদনের তাল কাটেনি। সড়কে লাঠি ঠোকার সঙ্গে ড্রামের সমন্বিত এই শব্দ জানান দেওয়া, ‘আমরাও আছি।’



প্রথমে ধীর লয়ে, ক্রমে বাড়তে থাকে শব্দ। সবার মুখে তখন উচ্চারিত হচ্ছে ‘হু’। শব্দ বেড়েছে লাঠির তালের সঙ্গে সঙ্গে। এর মধ্যে ঝিনুক নামে তৃতীয় লিঙ্গের একজন ক্রমাগত লাঠি ঠুকে শেষ পর্যন্ত ভেঙেই ফেললেন সেটি।


ড্রাম, লাঠির আওয়াজ আর ‘হু’ মিলেমিশে তৈরি হয় তীব্র দ্যোতনা। দর্শকেরা বলছিলেন, প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই প্রকাশের এই পদ্ধতি অভিনব। নারীর ক্ষোভ জানান দেওয়ার প্রতীকী ভাষার এই আয়োজনের নাম ‘হিম্মতি মাঈ’।


১৯৩৯ সালে জার্মান নাট্যকার বের্টল্ট ব্রেখটের লেখা মাদার কারেজ অ্যান্ড হার চিলড্রেন নাটকের বাংলা অনূদিত নাম থেকে ‘হিম্মতি মাঈ’ (জননী সাহসিকা) নামটি রাখা হয়েছে বলে জানালেন কর্মসূচির প্রধান আয়োজক শিল্পী ঋতু সাত্তার। প্রতীকী প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে নারীর বীরত্বের শক্তি অনেক বেশি জোরালো হয় বলে প্রথম আলোকে জানালেন কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া কয়েকজন নারী। তাঁরা বলছিলেন, কর্মসূচি বাউন্ডারির ভেতরেও হতে পারত। কিন্তু ব্যস্ত সড়কে দাঁড়িয়ে তাঁরা বলতে চান, রাজপথ শুধু পুরুষের নয়, সমান অধিকার আছে নারীরও।




সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জেলায় নারীদের ওপর ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনার পটভূমিতে আয়োজন করা হয় এই কর্মসূচির। এতে অংশ নেন সমাজের সব শ্রেণি, বয়স ও পেশার নারীরা—অধ্যাপক থেকে পোশাকশ্রমিক, গৃহিণী থেকে শিক্ষার্থী। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন সম্প্রতি অংশ নেন নরসিংদীর রেলস্টেশনের ‘অহিংস অগ্রযাত্রা’ কর্মসূচিতে। ১৮ মে ঢাকা থেকে নরসিংদী গিয়ে রেলস্টেশনে হেনস্তার শিকার হন এক তরুণী। ওই ঘটনার প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ওই কর্মসূচি।


‘হিম্মতি মাঈ’–এর আয়োজকেরা জানালেন, কোনো স্লোগান বা বক্তব্য দিয়ে নয়, বরং প্রকৃতি থেকে তৈরি করা শব্দ দিয়ে তাঁরা জানাতে চান, নারীর পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রকাশ পেলে ক্রমশ তার শব্দ বাড়তে থাকে। লাঠি ধরার অধিকার যেমন পুরুষের আছে, তেমনি নারীরও রয়েছে নিজেকে রক্ষার অধিকার। এই কর্মসূচি পুরুষের বিপক্ষে কোনো আন্দোলন নয়। বরং নারীর প্রতি সমাজের সব সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে এ উদ্যোগ বলে জানালেন তাঁরা।



চলচ্চিত্র নির্মাতা ইমতিয়াজ পাভেল প্রথম আলোকে বললেন, ‘দেশে নারীর প্রতি সহিংসতায় কঠোর আইন আছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খুব অল্প কয়েকজন ভুক্তভোগী যথার্থ বিচার পেয়ে থাকেন। আজকের এই আওয়াজ হলো সেই সহিংসতার বিরুদ্ধে চিৎকার।’


শিল্পী ঋতু সাত্তার বললেন, ‘নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের একলাশপুরে নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। দেলোয়ার বাহিনীর বিরুদ্ধে সেই নির্যাতিতার মানসিক শক্তিই আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। ওই নারী আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তা আমাদের সবার জন্য দৃষ্টান্ত।’


এক ঘণ্টা ধরে আয়োজিত কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া নারীরা প্রতিটি মুহূর্তে শব্দ তুলে জানিয়েছেন তাঁদের অবস্থান। আয়োজনের শেষে কয়েক মিনিটের জন্য লাঠিখেলা প্রদর্শন করে দেখালেন, নিজেকে রক্ষায় প্রয়োজনে শক্তির ব্যবহার করতে হলেও কম যান না তাঁরা। শেষ মুহূর্তে একসঙ্গে চিৎকার করে ‘হু’ শব্দে আবার জানিয়ে দিলেন—‘আমরাও আছি।’


কোন মন্তব্য নেই

imagedepotpro থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.